কাব্যপ্রকাশ - দ্বিতীয় উল্লাস
- শব্দ ৩ প্রকার – বাচক, লাক্ষণিক ও ব্যঞ্জক।
- অর্থও ৩ প্রকার – বাচ্য, লক্ষ্য ও ব্যঙ্গ্য।
- চতুর্থ প্রকার অর্থ হল তাৎপর্যার্থ। এটি অভিহিতান্বয়বাদী কুমারিলভট্ট প্রভৃতির মত। মম্মটাচার্যও এই মতকে সমর্থন করেন। অন্বিতাধানবাদী প্রভাকর প্রভৃতি এই চতুর্থ অর্থের স্বীকার করেন না।
- শব্দ যেমন ব্যঞ্জক হয় তেমন অর্থও ব্যঞ্জক হয়।
- বাচ্যার্থের ব্যঞ্জকতার উদাহরণ হল –
মাতর্গৃহোপকরণমদ্য খলু নাস্তীতি সাধিতং ত্বয়া।
তদ্ ভণ কিং করণীয়মেবমেব ন বাসরঃ স্থায়ী।।
- লক্ষ্যার্থের ব্যঞ্জকতার উদাহরণ হল –
সাধয়ন্তী সখি সুভগং ক্ষণে ক্ষণে দূনাসি মৎকৃতে।
সদ্ভাবস্নেহকরণীয়সদৃশকং তাবদ্ বিরচিতং ত্বয়া।।
- ব্যঙ্গ্যার্থের ব্যঞ্জকতার উদাহরণ হল –
পশ্য নিশ্চলনিষ্পন্দা বিসিনীপত্রে রাজতে বলাকা।
নির্মলমরকতভাজনপরিস্থিতা শঙ্খশুক্তিরিব।।
- যে শব্দ সাক্ষাৎ সংকেতিত অর্থকে বোঝায় সেই শব্দকে বাচক বলে (साक्षात्संकेतितं योऽर्थमभिधत्ते स वाचकः)। এই শব্দ থেকে এই অর্থ বুঝতে হবে এই বিষয়টাকেই বলা হয় শক্তিগ্রহ বা সংকেতগ্রহ। যথা – ঘটশব্দের কম্বুগ্রীবাদিমান্ অর্থ বোঝাতে সক্ষম হলে বলা হয় ঘটশব্দের কম্বুগ্রীবাদিমান্ অর্থে শক্তি আছে, সেই শক্তির জ্ঞান হলে তাকে শক্তিগ্রহ বা সংকেতগ্রহ বলা হয়। শক্তিগ্রহ ছাড়া কোন শব্দের কি অর্থ তা বোঝা যায় না। আমরা যখন প্রথম কোনো জিনিস দেখি তখন সেটা কি তা আমরা বুঝতে পারি না, তখন অপর একজন বলে দেয় এটা এই, তার থেকে আমরা বুঝতে পারি। এক শিশু প্রথম যখন গোরু দেখে সে জানে না এটা কি তখন তার পিতা তাকে বলে এটা হল গোরু, তখন সে বোঝে চারটে পা, দুটো শিং, গলকম্বলযুক্ত প্রাণীটি হল গোরু অথবা গোরু মানে হল চারটে পা, দুটো শিং, গলকম্বলযুক্ত প্রাণী। পরিষ্কার করে বললে বলতে হয় পদপদার্থসম্বন্ধ হল শক্তি অর্থাৎ পদ এবং পদার্থের মধ্যে যে সম্বন্ধ তাই হল শক্তি। যথা গোরু শব্দের অর্থ হল চারটে পা, দুটো শিং, গলকম্বলযুক্ত প্রাণী অথবা চারটে পা, দুটো শিং, গলকম্বলযুক্ত প্রাণীর প্রতিপাদক শব্দ হল গোরু। এই শব্দের দ্বারা এই অর্থকেই বুঝতে হবে অথবা এই অর্থের প্রতিপাদক হল এই শব্দ এই নির্ধারণ করতে পারার নামই হল শক্তিগ্রহ অথবা সংকেতগ্রহ। নিষ্কর্ষরূপে বলা যায় ব্যবহার, ব্যাকরণ, কোশ প্রভৃতি থেকে এই শব্দের এই অর্থ এই প্রাথমিক বোধকেই শক্তিগ্রহ অথবা সংকেতগ্রহ বলা হয়।
- এই শক্তিগ্রহ যার থাকে সে যে শব্দ শুনে শব্দের প্রাথমিক অর্থ বুঝতে পারে সেই শব্দকে বাচক বলে। ঐ প্রাথমিক অর্থকেই মুখ্যার্থ বলা হয়।
- এই মুখ্যার্থ ৪ প্রকারের হয় – জাতি, গুণ, ক্রিয়া এবং সংজ্ঞা। এখানে একটি প্রশ্ন হতে পারে শব্দের অর্থ যদি এই ৪ প্রকার হয়, তাহলে ঘটম্ আনয় এখানে ঘট শব্দের অর্থ ঘটত্ব হবে, ঘটত্বকে আনা যায় না, তাই ঘটব্যক্তিকে আনতে হবে। তাই অর্থ হিসাবে ব্যক্তিকে ধরতে হবে, জাতি প্রভৃতিকে নয়। তার উত্তর এইরূপ– যদিও একমাত্র ব্যক্তিই প্রয়োজনসাধনে সমর্থ এবং সেই কোনো কাজে প্রবৃত্ত হওয়ার অথবা নিবৃত্ত হবার যোগ্য তবুও আনন্ত্য ও ব্যভিচার এই দুপ্রকার দোষনিবারণের জন্য জাতি প্রভৃতিকে অর্থরূপে স্বীকার করা হয়।
- যদি ব্যক্তিকেই অর্থরূপে স্বীকার করা হয় তাহলে ‘গৌঃ শুক্লঃ চলঃ ডিত্থঃ’ এই প্রয়োগ করা যাবে না। কারণ গৌঃ শব্দের অর্থ গোব্যক্তি এবং শুক্লশব্দের অর্থও গোব্যক্তি এবং চলশব্দেরও তাই ডিত্থশব্দেরও তাই। এক অর্থ প্রতিপাদনের জন্য একের বেশি শব্দের প্রয়োগ অনর্থক। যেমন ঘট আনার জন্য ঘটম্ আনয় বললেই চলে ঘটং কলসম্ আনয় বলার দরকার হয় না, এখানেও গৌঃ বললেই হয়ে যাবে শুক্লঃ চলঃ ডিত্থঃ বলার দরকার নেই কিন্তু জাতি প্রভৃতিকে অর্থরূপে স্বীকার করলে উক্ত প্রয়োগের যথার্থতা সিদ্ধ হয়। কারণ গোত্বজাতিমান্ বোঝাতে গোশব্দ, শুক্লত্বগুণবান্ বোঝাতে শুক্লশব্দ, চলনক্রিয়াবান্ বোঝাতে চলশব্দ এবং ডিত্থসংজ্ঞাবান্ বোঝাতে ডিত্থশব্দ। চারটি পদের প্রয়োগই সার্থক হয়। তাই ব্যক্তি অর্থ এই মতবাদ গ্রহণীয় নয়।
- তাই জাতি প্রভৃতি শব্দের অর্থ। তার প্রতিপাদনের জন্য বলছেন– উপাধি ২ প্রকার - বস্তুধর্ম এবং বক্তার ইচ্ছা অনুসারে সন্নিবেশিত। বস্তুধর্ম ২ প্রকার - সিদ্ধ ও সাধ্য। সিদ্ধও ২ প্রকার – পদার্থের প্রাণপ্রদ এবং বিশেষত্ব নির্বাহের কারণ। পদার্থের প্রাণপ্রদ হল জাতি। প্রাণং ব্যবহারযোগ্যতাং প্রদদাতি সম্পাদয়তি ইতি প্রাণপ্রদঃ জাতিঃ। বিশেষত্বনির্বাহের কারণ হল গুণ। যে বস্তু নিজের সত্তা লাভ করেছে সেই বস্তু শুক্ল প্রভৃতি গুণের দ্বারা বিশিষ্টতা প্রাপ্ত হয়। আর সাধ্য হল ক্রিয়া। বক্তার ইচ্ছা অনুসারে সন্নিবেশিত হল সংজ্ঞা অর্থাৎ নাম। তাই মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি বলেছেন– “গৌঃ শুক্লশ্চলো ডিত্থ ইত্যাদৌ চতুষ্টয়ী শব্দানাং প্রবৃত্তিঃ”। শব্দের জাতি, গুণ, ক্রিয়া এবং সংজ্ঞাতে শক্তি এই মতটি বৈয়াকরণসম্মত।
- পূর্বমীমাংসক কুমারিল প্রভৃতির মতে জাতিই হল শব্দের অর্থ অর্থাৎ শব্দের জাতিতে শক্তি। গুণ, ক্রিয়া এবং সংজ্ঞার জাতিতেই অন্তর্ভাব হয়। যথা – তুষার, দুগ্ধ এবং শঙ্খ প্রভৃতি আশ্রয়ে প্রতীত শুক্লগুণ বিভিন্ন হলেও যে কারণে অভিন্ন প্রতীত হয় তা হল শুক্লত্বজাতি, গুড়ের পাক এবং তণ্ডুলের পাক প্রভৃতি স্থলে প্রতীত পাকক্রিয়া বিভিন্ন হলেও যে কারণে অভিন্ন প্রতীত হয় তা হল পাকত্বজাতি, সংজ্ঞা আশ্রয়ভেদে ভিন্ন হলেও বাল্য অবস্থায় যাকে ডিত্থ বলা হয় বার্ধক্যেও তাকে ডিত্থ বলা হয় তার কারণ ডিত্থত্বজাতি। তাই গুণ, ক্রিয়া এবং সংজ্ঞা ভিন্নরূপে প্রতীত হলেও তা জাতি থেকে ভিন্ন নয়, যেমন একই মুখ দর্পণে একরকম খড্গে অন্যরকম, তৈলে আবার অন্যরকম প্রতীত হয় ঠিক তেমনই আপাত ভেদমাত্র। তেমন জাতিই তত্ত্ব।
- নৈয়ায়িকদের মতে জাতিবিশিষ্টব্যক্তিতে শব্দের শক্তি। তদ্বান্ এই পদের দ্বারা মম্মট তাই বুঝিয়েছেন।
- অপোহ হল শব্দের অর্থ এই বৌদ্ধমতেরও উল্লেখ করেছেন। অপোহ শব্দের তাৎপর্য হল বিপরীতের ন্যগ্ভাব। যেমন গো শব্দের অর্থ হল গোভিন্ন অশ্বাদি তাদের ব্যবৃত্তি করলে যা পড়ে থাকে তাই হল গোরু।
- বৈয়াকরণদের মতে শব্দের জাতি, গুণ, ক্রিয়া এবং সংজ্ঞাতে শক্তি, পূর্বমীমাংসকদের মতে শব্দের জাতিতে শক্তি, নৈয়ায়িকদের মতে জাতিবিশিষ্টব্যক্তিতে শক্তি, বৌদ্ধদের মতে অপোহে শক্তি।
******
Kavyaprakash 2nd Chapter
No comments:
Post a Comment