কাব্যপ্রকাশ
প্রথম উল্লাস
- মঙ্গলাচরণে মম্মটাচার্য ভারতীর অর্থাৎ সরস্বতীর বন্দনা করেছেন।
- মঙ্গলাচরণে ব্রহ্মার দ্বারা নির্মিত জগতের থেকে কবিবাঙ্ময়ের পার্থক্য দেখিয়েছেন– ব্রহ্মার জগৎ ব্রহ্মার নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যথা – দিবাকালে সূর্য, রাত্রিতে চন্দ্র কিন্তু কবিবাঙ্ময় ব্রহ্মার নিয়মের দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত, এখানে দিবাকালেও চন্দ্রোদয় সম্ভব। ব্রহ্মার জগৎ সুখ-দুঃখ-মোহময় কিন্তু কবিবাঙ্ময় কেবল আনন্দময়। পরমাণু প্রভৃতি উপাদান কারণ এবং কর্ম প্রভৃতি সহকারিকারণের উপর নির্ভরশীল ব্রহ্মার জগৎ, কিন্তু কবিবাঙ্ময় স্বতন্ত্র। ব্রহ্মার জগতে মধুর, অম্ল, লবণ, কটু, কষায় ও তিক্তরূপ ষড্ রস আছে, তা সত্ত্বেও তা সবার প্রিয় নয়, ব্যক্তিবিশেষের যা প্রিয় অন্যব্যক্তির তা অপ্রিয়। কিন্তু কবিবাঙ্ময়ের শৃঙ্গারাদিরস নব রস সবার প্রিয়।
- প্রথম উল্লাসে কাব্যের ছটি প্রয়োজন দেখিয়েছেন–
কাব্যং যশসেঽর্থকৃতে ব্যবহারবিদে শিবেতরক্ষতয়ে।
সদ্যঃ পরনির্বৃতয়ে কান্তাসম্মিততয়োপদেশযুজে॥
o
যশ – কালিদাসের
যথা।
o
অর্থ – শ্রীহর্ষ
প্রভৃতি নৃপতির থেকে ধাবক প্রভৃতি কবির যথা।
o
ব্যবহারজ্ঞান –
রাজা ও অনান্য ব্যক্তিদের উপযুক্ত আচারপরিজ্ঞান।
o
অমঙ্গলনাশ
(শিবেতরক্ষতি) – আদিত্য প্রভৃতি দেবগণের থেকে ময়ূর প্রভৃতি কবির যথা।
o
আনন্দপ্রাপ্তি –
কাব্য থেকে কবি ও সহৃদয়ের আনন্দপ্রাপ্তি।
o কান্তাসম্মিত – বেদ প্রভুর মতো আদেশ করে তাই বেদ প্রভুসম্মিত, পুরাণ মিত্রের মতো যুক্তাযুক্ত তুলে ধরে তাই পুরাণ মিত্রসম্মিত, কাব্য হল কান্তা অর্থাৎ পত্নীর মতো যে উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হয় না কিন্তু যথাযথ মার্গে প্রবৃত্তও করে।
- কাব্যরচনার জন্য ৩টি হেতুর নির্দেশ করেছেন –
শক্তির্নিপুণতা লোকশাস্ত্রকাব্যাদ্যবেক্ষণাৎ।
কাব্যজ্ঞশিক্ষয়াভ্যাস ইতি হেতুস্তদুদ্ভবে॥
শক্তি, লোক-শাস্ত্র-কাব্য প্রভৃতির পর্যালোচনার দ্বারা লব্ধ নিপুণতা এবং কাব্যজ্ঞদের
থেকে লব্ধ শিক্ষার অভ্যাস। শক্তি, নিপুণতা এবং অভ্যাস এই তিনের সমুদায়
কাব্যসৃষ্টির প্রতি কারণ। যথা ঘট তৈরী করতে গেলে দণ্ড, চক্র, কুলাল তিনজনকেই লাগে
একটির অভাবে হয় না তেমন এখানেও।
- কাব্যের সংজ্ঞাটি হল – দোষশূন্য, গুণযুক্ত, অলঙ্কারবিশিষ্ট অথবা কখনও কখনও অলঙ্কারশূন্য শব্দ এবং অর্থকে কাব্য বলে (তদদোষৌ শব্দার্থৌ সগুণাবনলংকৃতী পুনঃ ক্বাপি)। অস্ফুটালঙ্কারের উদাহরণ হল–
যঃ কৌমারহরঃ স এব হি বরস্তা এব চৈত্রক্ষপা-
স্তে চোন্মীলিতমালতীসুরভয়ঃ প্রৌঢাঃ কদম্বানিলাঃ।
সা চৈবাস্মি তথাপি তত্র সুরতব্যাপারলীলাবিধৌ
রেবারোধসি বেতসীতরুতলে চেতঃ সমুৎকণ্ঠতে ॥
- মম্মটাচার্য উত্তম, মধ্যম ও অধম ভেদে কাব্যকে ৩ শ্রেণীতে ভাগ করেছেন।
- যে কাব্যে বাচ্যার্থ অপেক্ষা ব্যঙ্গ্যার্থ অধিকতর চমৎকারক তাকে পণ্ডিতগণ ‘ধ্বনি’ নামক উত্তম কাব্য বলেন (ইদমুত্তমমতিশয়িনি ব্যঙ্গ্যে বাচ্যাদ্ ধ্বনির্বুধৈঃ কথিতঃ)। উদাহরণ–
নিঃশেষচ্যুতচন্দনং স্তনতটং নির্মৃষ্টরাগোঽধরো
নেত্রে দূরমনঞ্জনে পুলকিতা তন্বী তবেয়ং তনুঃ।
মিথ্যাবাদিনি দূতি বান্ধবজনস্যাজ্ঞাতপীডাগমে
বাপীং স্নাতুমিতো গতাসি ন পুনস্তস্যাধমস্যান্তিকম্॥
- যে কাব্যে ব্যঙ্গ্যার্থ বাচ্যার্থের সমান অথবা তার থেকেও কম চমৎকারক তাকে ‘গুণীভূতব্যঙ্গ্য’ নামক মধ্যম কাব্য বলে (অতাদৃশি গুণীভূতব্যঙ্গ্যং ব্যঙ্গ্যে তু মধ্যমম্)। উদাহরণ–
গ্রামতরুণং তরুণ্যা নববঞ্জুলমজ্জরীসনাথকরম্।
পশ্যন্ত্যা ভবতি মুহুর্নিতরাং মলিনা মুখচ্ছায়া॥
- শব্দবৈচিত্র্য ও অর্থবৈচিত্র্যযুক্ত ব্যঙ্গ্যার্থশূন্য কাব্যকে ‘অবর’ নামক অধমকাব্য বলে (শব্দচিত্রং বাচ্যচিত্রমব্যঙ্গ্যং ত্ববরং স্মৃতম্)। লক্ষণে চিত্রশব্দের অর্থ গুণ ও অলঙ্কার যুক্ত। শব্দচিত্রের উদাহরণ–
স্বচ্ছন্দো-চ্ছলদ্-অচ্ছ-কচ্ছ-কুহর-চ্ছাতে-তরাম্বু-চ্ছটা-
মূর্ছন্-মোহ-মহর্ষি-হর্ষ-বিহিত-স্নানাহ্নিকাহ্নায় বঃ।
ভিদ্যাদ্-উদ্যদ্-উদার-দর্দুর-দরী দীর্ঘা-দরিদ্র-দ্রুম-
দ্রোহোদ্রেক-মহোর্মি-মেদুর-মদা মন্দাকিনী মন্দতাম্॥
- অর্থচিত্রের উদাহরণ হল–
বিনির্গতং মানদমাত্মমন্দিরাদ্ভবত্যুপশ্রুত্য যদৃচ্ছয়াপি যম্।
সসংভ্রমেন্দ্রদ্রুতপাতিতার্গলা নিমীলিতাক্ষীব ভিয়ামরাবতী॥
No comments:
Post a Comment