রসগঙ্গাধরের মঙ্গলাচরণ এবং কাব্যলক্ষণ
রসগঙ্গাধরের মঙ্গলশ্লোকটি হল–
কলিন্দগিরিনন্দিনীতটসুরদ্রুমালম্বিনী মদীয়মতিচুম্বিনী ভবতু কাপি কাদম্বিনী॥
জগন্নাথের গুরু ছিলেন
লক্ষ্মীকান্ত পেরুভট্ট। পেরুভট্ট সর্বতন্ত্রস্বতন্ত্র ছিলেন। তাঁর গুরুরা ছিলেন
- কাণাদ (বৈশেষিক) ও অক্ষপাদ (ন্যায়) –
মহেন্দ্র, মীমাংসা – খণ্ডদেব, ব্যাকরণ – শেষউপনামযুক্ত বীরেশ্বরপণ্ডিত
অলঙ্কারশাস্ত্রে অনান্য
আলঙ্কারিকদের পরিশ্রমকে তিনি তিমি মাছের সমুদ্র বিক্ষোভের সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং
নিজের পরিশ্রমকে মন্দর পর্বতের সমুদ্র বিক্ষোভের সঙ্গে। উদাহরণরূপে জগন্নাথ
স্বরচিত শ্লোক উপন্যস্ত করেছেন যা রসগঙ্গাধরের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য।
কাব্যরচনার প্রয়োজনগুলির মধ্যে (কবিপক্ষে) কীর্তি, গুরুরাজদেবতাপ্রসাদ ও (সহৃদয়পক্ষে) পরমাহ্লাদ এই তিনটির উল্লেখ করেছেন। জগন্নাথের মতে কাব্যলক্ষণটি হল–
রমণীয়ার্থপ্রতিপাদকঃ শব্দঃ কাব্যম্।
রমণীয়ার্থপ্রতিপাদক শব্দই কাব্য, অর্থ নয়। তাই ‘অদোষৌ সগুণৌ সালঙ্কারৌ শব্দার্থৌ কাব্যম্’ এই মম্মটকৃত লক্ষণটি নিরস্ত হয়। কটাক্ষাদিবারণের জন্য ‘শব্দ’ এই পদটি লক্ষণে দেওয়া হয়েছে। রমণীয়ার্থবাচক না বলে প্রতিপাদক বলার ফল ব্যঞ্জক ও লক্ষকের কাব্যত্বহানি ঘটে না। রমণীয়শব্দ প্রতিপাদককে কাব্য বললে ব্যাকরণে অতিব্যাপ্তি হবে। এখানে রমণীয় শব্দটি পারিভাষিক। যে বস্তুর জ্ঞানে লোকোত্তর আহ্লাদ উৎপন্ন হয় তাই রমণীয়। সেই লোকোত্তর আহ্লাদের প্রতিপাদক শব্দরাশি কাব্য। তাই লৌকিক আনন্দ জনক ‘পুত্রস্তে জাতঃ’ ‘ধনং তে দাস্যামি’ ইত্যাদি বাক্য কাব্যপদবাচ্য হয় না। এটি ধ্যেয় যে জগন্নাথের মতে শব্দই কাব্য অর্থ নয়। কাব্যমুচ্চৈঃ পঠতি, কাব্যাদর্থোঽবগম্যতে ইত্যাদি বাক্যে কাব্যশব্দের শব্দই অর্থ। মম্মট শব্দার্থের বিশেষণরূপে গুণ ও অলংকার শব্দের প্রয়োগ করেছেন তাও জগন্নাথের মতে অযৌক্তিক। তাহলে কোনো বাক্যে গুণ ও অলঙ্কারের অনুপস্থিতি হলে সেই বাক্যের কাব্যত্বহানি ঘটবে। যথা - ‘উদিতং মণ্ডলং বিধোঃ’ ‘গতোঽস্তমর্কঃ’ ইত্যাদিবাক্যের কাব্যতা বাধিত হবে। তাছাড়াও গুণ হল রসের ধর্ম তাই শব্দার্থের বিশেষণরূপে উপন্যাস অযৌক্তিক, অলঙ্কারও অস্থায়ি ধর্ম তাই তার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক নয়। অন্যথা যেখানে গুণ ও অলঙ্কার বর্তমান সেই অংশ কাব্য অন্য অংশ অকাব্য এই রকম ব্যবহারের আপত্তি হবে। এই রকম ব্যবহার সম্প্রদায়বিরুদ্ধ। এবং বিশ্বনাথকৃত ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্’ এই লক্ষণটিএ যুক্ত নয়। সর্বত্র রসের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক হলে বস্ত্বলঙ্কারপ্রধান কাব্যের কাব্যত্বহানি ঘটবে।
*****
No comments:
Post a Comment