জগন্নাথের মতে কাব্যের কারণ এবং কাব্যের প্রকারভেদ
জগন্নাথের মতে কাব্যের কারণ শুধুমাত্র প্রতিভা, নিপুণতা ও অভ্যাস নয়। এর ফলে শক্তি (প্রতিভা), নিপুণতা ও অভ্যাস এই তিনটি কাব্যসৃষ্টিতে সমুদিত হেতু এরূপ মম্মটসিদ্ধান্ত খণ্ডিত হয়। প্রতিভার স্বরূপটি হল - ‘কাব্যঘটনানুকূলশব্দার্থোপস্থিতিঃ’ অর্থাৎ কাব্যরচনার অনুকূল শব্দ এবং অর্থের উপস্থিতি। প্রতিভার হেতু হল কোনস্থলে দেবতা ও মহাপুরুষদের আশীর্বাদের ফল অর্থাৎ অদৃষ্ট, কোনস্থলে ব্যুৎপত্তি অর্থাৎ লোকশাস্ত্রাদিবিষয়ে জ্ঞান, কোনস্থলে কাব্যরচনার অভ্যাস (তৃণারণিমণিন্যায়ে তিনটিই প্রতিভার প্রতি পৃথক্ কারণ)।
কাব্য ৪ প্রকার – ১) উত্তমোত্তম ২) উত্তম ৩) মধ্যম ৪) অধম
১) উত্তমোত্তম – ‘শব্দার্থৌ যত্র গুণীভাবিতাত্মানৌ কমপ্যর্থমভিব্যঙ্ক্তস্তদাদ্যম্’ অর্থাৎ যেখানে শব্দ নিজেকে এবং বাচ্যার্থকে অপ্রধান করে চমৎকারের জন্য অপর কোন পদার্থকে প্রকাশ করে তাকে উত্তমোত্তম কাব্য বলে। যথা –
শয়িতা সবিধেঽপ্যনীশ্বরা সফলীকর্তুমহো মনারথান্।
দয়িতা দয়িতাননাম্বুজং দরমীলন্নয়না নিরীক্ষতে।।
নিকটে শয়িতা কিন্তু মনোরথ সফল করতে অক্ষমা ঈষৎনিমীলিতাক্ষী দয়িতা দয়িতের মুখপদ্ম নিরীক্ষণ করছে। রসসূত্রে বলা হয়েছে - ‘বিভাবানুভাবব্যভিচারিসংযোগাদ্ রসনিষ্পত্তিঃ’। এখানে আলম্বন বিভাব নায়ক, উদ্দীপনবিভাব নিকটে শয়নের দ্বারা আক্ষিপ্ত নির্জন স্থান; নিরীক্ষণ হল অনুভাব এবং লজ্জা ও ঔৎসুক্য হল ব্যভিচারিভাব। উক্ত বিভাব, অনুভাব এবং ব্যভিচারী ভাবের সংযোগে নায়িকাশ্রিত নায়কবিষয়ক রতি প্রকাশিত হয়েছে। জগন্নাথপ্রদর্শিত উদাহরণান্তর –
গুরুমধ্যগতা ময়া নতাঙ্গী, নিহতা নীরজকোরকেণ মন্দম্।
দরকুণ্ডলতাণ্ডবং নতভ্রূলতিকং মামবলোক্য ঘূর্ণিতাসীৎ।।
গুরুজনের মধ্যে উপবিষ্টা অবনতাঙ্গীকে আমি পদ্মকোরক দিয়ে মৃদু আঘাত করলে সে কর্ণকুণ্ডলকে আন্দোলিত করে ভ্রূলতা নত করে সবেগে মুখ ফিরিয়ে নিল। এখানে ঘূর্ণিতাসীৎ অংশটির দ্বারা ‘হে অবিবেচক একি অনুচিত কার্য় করলে’ এইরূপ অসহিষ্ণুতা প্রধানভাবে ব্যক্ত হয়েছে। এখানে শব্দ ও অর্থ অপ্রধান। এই প্রভেদকেই আলঙ্কারিকবর্গ ধ্বনি নামে অভিহিত করেন।
২) উত্তম – ‘য়ত্র ব্যঙ্গ্যমপ্রধানমেব সচ্চমৎকারকারণং তদ্ দ্বিতীয়ম্’ অর্থাৎ যে স্থলে ব্যঙ্গ্য কেবল অপ্রধানরূপেই প্রতীয়মান হয়ে চমৎকারের কারণ হয় তাকে দ্বিতীয় শ্রেণীর কাব্য অর্থাৎ উত্তমকাব্য বলে। যথা –
রাঘববিরহজ্বালাসংতাপিতসহ্যশৈলশিখরেষু।
শিশিরে সুখং শয়ানাঃ কপয়ঃ কুপ্যন্তি পবনতনয়ায়।।
রামের বিরহানলে সন্তপ্ত সহ্য পর্বতের শিখরে শীতকালে সুখে শয়িত বানরের দল হনুমানের উপর কুপিত হচ্ছে। তাদের ক্রোধের কারণ হল হনুমান্ রামকে সীতার সংবাদ দিয়ে শীতল করেছে বলে সহ্য পর্বতের উষ্ণতা দূর হয়েছে, তার ফলে বানরদের উষ্ণতাজন্য আরাম বিনষ্ট হয়েছে। এখানে জানকীর কুশলবার্তাতে রামচন্দ্র শীতল হয়েছে এই ব্যঙ্গার্থ বানরদের অহেতুক কোপের কারণের সমর্থক। এখানে বাচ্যর্থের সমর্থক ব্যঙ্গার্থ তাই গুণীভূত তবুও চমৎকারের জনক বলে উত্তম কাব্য হয়েছে।
মধ্যম - ‘য়ত্র ব্যঙ্গ্যচমৎকারাসমানাধিকরণো বাচ্যচমৎকারঃ তত্ তৃতীয়ম্’ অর্থাৎ যেখানে বাচ্যার্থের চমৎকৃতি ব্যঙ্গ্যার্থের চমৎকৃতি অপেক্ষা স্ফুটতর তাকে মধ্যম কাব্য বলে। যথা – যমুনাবর্ণনা - ‘তনয়মৈনাকগবেষণলম্বীকৃতজলধি-জঠর-প্রবিষ্ট-হিমগিরি-ভুজায়মানায়াঃ ভগবত্যা ভাগীরথ্যাঃ সখী’ তনয়তুল্য মৈনাকের অনুসন্ধানের জন্য সমুদ্রমধ্যে প্রবিষ্ট হিমালয়ের প্রসারিত বাহুস্বরূপ ভাগীরথীর সখী। এখানে হিমালয়ের বাহু এই উৎপ্রেক্ষাই চমৎকৃতির কারণ এবং এটি বাচ্যার্থ যা শ্বৈত্য পাতালতলচুম্বিত্ব প্রভৃতি ব্যঙ্গ্যার্থকে ম্লান করেছে।
অধম - ‘য়ত্রার্থচমৎকৃত্যুপস্কৃতা শব্দচমৎকৃতিঃ প্রধানং তদধমং চতুর্থম্’ অর্থাৎ যেখানে অর্থচমৎকৃতির দ্বারা ভূষিত শব্দচমৎকৃতি প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয় তাকে চতুর্থ শ্রেণীর কাব্য অর্থাৎ অধম কাব্য বলে। যথা –
মিত্রাত্রিপুত্রনেত্রায় ত্রয়ীশাত্রবশত্রবে।
গোত্রারিগোত্রজত্রায় গোত্রাত্রে তে নমো নমঃ।।
মিত্র (সূর্য) এবং অত্রিপুত্র (চন্দ্র) যাঁর নেত্র, ত্রয়ীর (বেদের) সঙ্গে শত্রুতাযুক্ত দানবগণের যিনি শত্রু, গোত্রারির (ইন্দ্রের) সমগোত্রসম্পন্নদের (দেবগণের) যিনি ত্রাণকর্তা সেই গোত্রাতাকে (শিব অথবা বিষ্ণু) আমি রক্ষা করি।
যে স্থলে অর্থচমৎকৃতিশূন্য শব্দচমৎকৃতি বর্তমান (একাক্ষরপদ্য, অর্ধাবৃত্তিযমক, পদ্মবন্ধ প্রভৃতি) তাকে পঞ্চম শ্রেণীর কাব্য অধমাধম কাব্যও বলা যায় তবুও রমণীয়ার্থপ্রতিপাদক না হওয়ার জন্য তাদের কাব্যত্বই নেই তাই অধমাধম এই বিভাগ জগন্নাথ দেখাননি। যদিও প্রাচীন পরম্পরা অনুসরণ করে মহাকবিবৃন্দ তাকে কাব্যর মধ্যে স্থান দিয়েছেন।
*****
No comments:
Post a Comment