সাহিত্যদর্পণ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
সাহিত্যদর্পণ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ (Part - 2)
ব্যঞ্জনা
Ø যে শক্তির দ্বারা শব্দ এবং অর্থ থেকে অভিধা, লক্ষণা এবং তাৎপর্য বৃত্তি বিরত হলে যে বৃত্তির দ্বারা বাচ্য, লক্ষ্য, তাৎপর্য ভিন্ন অপর কোনো অর্থের প্রতীতি হয় তাকে ব্যঞ্জনা বলে। বিশ্বনাথের ভাষায়–
বিরতাস্বভিধাদ্যাসু যযার্থো বোধ্যতেঽপরঃ।
সা বৃত্তির্ব্যঞ্জনা নাম শব্দস্যার্থাদিকস্য চ॥
Ø ব্যঞ্জনা ২ প্রকার শাব্দী ব্যঞ্জনা ও আর্থী ব্যঞ্জনা। শাব্দী ব্যঞ্জনা আবার অভিধামূলা ও লক্ষণামূলা ভেদে ২ প্রকার।
Ø অনেকার্থবিশিষ্ট শব্দের সংযোগাদি দ্বারা কোনো একটি বিশেষ অর্থের প্রতিপাদন যে শক্তির দ্বারা হয় তাকে অভিধামূলা ব্যঞ্জনা বলে। অনেকার্থবিশিষ্ট শব্দের কোনো একটি বিশেষ অর্থ প্রতিপাদনে সহায়কেরা হল–
সংযোগো বিপ্রয়োগশ্চ সাহচর্যং বিরোধিতা।
অর্থঃ প্রকরণং লিঙ্গং শব্দস্যান্যস্য সন্নিধিঃ॥
সামর্থ্যমৌচিতী দেশঃ কালো ব্যক্তিঃ স্বরাদয়ঃ।
শব্দার্থস্যানবচ্ছেদে বিশেষস্মৃতিহেতবঃ॥
Ø ক্রমশঃ উদাহরণগুলি হল–
o সংযোগ – সশঙ্খচক্রো হরিঃ। (হরি শব্দের অনেক অর্থ, যথা – যম, অনিল, ইন্দ্র, চন্দ্র, সূর্য, বিষ্ণু, সিংহ, বাজী, কপি প্রভৃতি তা সত্ত্বেও শঙ্খচক্রের সংযোগ থাকায় এখানে হরি শব্দের বিষ্ণু অর্থে শক্তি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে)
o বিপ্রয়োগ – অশঙ্খচক্রো হরিঃ। (শঙ্খচক্রবিয়োগের দ্বারা বিষ্ণু কে বোঝানো হচ্ছে)
o সাহচর্য – ভীমার্জুনৌ। (ভীমের সাহচর্যবশতঃ অর্জুন হল কুন্তীপুত্র, অর্জুন বৃক্ষ প্রভৃতি নয়)
o বিরোধিতা – কর্ণার্জুনৌ। (কর্ণের বিরোধিতাবশতঃ অর্জুন হল কুন্তীপুত্র)
o অর্থ (প্রয়োজন) – স্থাণুং বন্দে। (বন্দনার্থের সার্থকতা প্রতিপাদনের জন্য স্থাণুর অর্থ শিব, স্তম্ভ নয়)
o প্রকরণ – সর্বং জানাতি দেবঃ। (এখানে প্রকরণবশতঃ দেবশব্দের অর্থ দেবতা নয় কিন্তু সম্মুখস্থ রাজা)
o লিঙ্গ – কুপিতো মকরধ্বজঃ। (কোপ হল প্রাণির ধর্ম তাই মকরধ্বজ শব্দের অর্থ কামদেব, অচেতন সমুদ্র নয়)
o অন্য শব্দের সন্নিধি – দেবঃ পুরারিঃ। (পুরারি শব্দের অর্থ শিব এবং খল হয়, কিন্তু দেবপদের সান্নিধ্যবশতঃ পুরারি এখানে শিব)
o সামর্থ্য – মধুনা মত্তঃ পিকঃ। (এখানে কোকিলের মত্ততা সামর্থ্যবশতঃ মধু শব্দের বসন্ত অর্থ মদ্য নয়)
o ঔচিতী – যাতু বো দয়িতামুখম্। (এখানে ঔচিত্যবশতঃ মুখশব্দের অর্থ সাম্মুখ্য, বদন নয়)
o দেশ – বিভাতি গগনে চন্দ্রঃ ( এখানে দেশবাচক গগন শব্দের যোগে চন্দ্র শব্দের অর্থ শশী, কর্পূর প্রভৃতি নয়)
o কাল – নিশি চিত্রভানুঃ। (এখানে কালবাচক নিশি শব্দ থাকায় চিত্রভানু শব্দের অর্থ বহ্নি, সূর্য নয়)
o ব্যক্তি (লিঙ্গ) – ভাতি রথাঙ্গম্। (এখানে রথাঙ্গশব্দের লিঙ্গ নপুংসক হওয়ায় চক্র অর্থ হয়েছে, চক্রবাক হয়নি)
Ø লক্ষণামূলা ব্যঞ্জনার উদাহরণ হল – গঙ্গায়াং ঘোষঃ। (প্রয়োজনমূলা লক্ষণা স্থলে প্রয়োজন প্রতিপাদন এই ব্যঞ্জনার দ্বারা হয়। গঙ্গা শব্দের জলপ্রবাহ অর্থ অভিধার দ্বারা প্রতিপাদিত হয়, কিন্তু জলপ্রবাহে ঘোষ অর্থাৎ গ্রাম থাকা সম্ভব নয় তাই লক্ষণার দ্বারা গঙ্গাশব্দের অর্থ তীর হয়। এখানে গঙ্গাতীরে গ্রাম বক্তা বলতে পারত কিন্তু বক্তা গ্রামে গঙ্গার মতোই শীতলতা এবং পবিত্রতা বিদ্যমান এটি প্রতিপাদনের উদ্দেশ্যে গঙ্গায়াং ঘোষঃ প্রয়োগ করেছেন। এখানে শীতলতা এবং পবিত্রতা অভিধা বা লক্ষণার দ্বারা প্রতিপাদন সম্ভব নয়। যেহেতু অভিধা জলপ্রবাহ বুঝিয়ে বিরত হয়েছে, লক্ষণা তীর বুঝিয়ে, তাই শীতলতা এবং পবিত্রতা প্রতিপাদনার ব্যঞ্জনার দ্বারা হয়। এই ব্যঞ্জনার মূল হল প্রয়োজনমূলা লক্ষণা তাই একে লক্ষণামূলা ব্যঞ্জনা বলে।)
Ø বিশ্বনাথ শাব্দীব্যঞ্জনার প্রতিপাদন করে আর্থীব্যঞ্জনার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। যে শক্তি বক্তা, বোদ্ধব্য অর্থাৎ শ্রোতা, বাক্য, অন্যসন্নিধি, বাচ্য, প্রস্তাব অর্থাৎ প্রকরণ, দেশ, কাল, কাকু, চেষ্টা প্রভৃতি বিশেষতাবশতঃ অন্য অর্থ প্রতীত করে তাকে আর্থী ব্যঞ্জনা বলে।
Ø বক্তা, বাক্য, প্রস্তাব, দেশ এবং কালের বিশেষতাবশতঃ অন্য অর্থের প্রতীতি হয়েছে, এমন উদাহরণ–
কালো মধুঃ কুপিত এষ চ পুষ্পধন্বা
ধীরা বহন্তি রতিখেদহরাঃ সমীরাঃ।
কেলীবনীয়মপি বঞ্জুলকুঞ্জমঞ্জু-
র্দূরে পতিঃ কথয় কিং করণীয়মদ্য॥
Ø বোদ্ধব্যবৈশিষ্ট্যের উদাহরণ –
নিঃশেষচ্যুতচন্দনং স্তনতটং নির্মৃষ্টরাগোঽধরো
নেত্রে দূরমনঞ্জনে পুলকিতা তন্বী তবেয়ং তনুঃ।
মিথ্যাবাদিনি দূতি বান্ধবজনস্যাজ্ঞাতপীড়াগমে
বাপীং স্নাতুমিতো গতাসি ন পুনস্তস্যাধমস্যান্তিকম্॥
Ø অন্যসন্নিধিবৈশিষ্ট্যের উদাহরণ–
পশ্য নিশ্চল নিষ্পন্দা বিসিনীপত্রে রাজতে বলাকা।
নির্মলমরকতভাজনপরিস্থিতা শঙ্খশুক্তিরিব॥
Ø পণ্ডিতগণ ভিন্নকণ্ঠধ্বনিকে অর্থাৎ বিকৃতকণ্ঠস্বরকে কাকু বলেন। কাকুবৈশিষ্ট্যের উদাহরণ–
গুরুপরতন্ত্রতয়া বত দূরতরং দেশমুদ্যতো গন্তুম্।
অলিকুলকোকিলললিতে নৈষ্যতি সখি সুরভিসময়েঽসৌ॥
Ø চেষ্টাবৈশিষ্ট্যের উদাহরণ–
সংকেতকালমানসং বিটং জ্ঞাত্বা বিদগ্ধয়া।
হসন্নেত্রার্পিতাকূতং লীলাপদ্মং নিমীলিতম্॥
Ø বাচ্য, লক্ষ্য ও ব্যঙ্গ্য ভেদে অর্থ ৩ প্রকার তাই সমস্ত আর্থী ব্যঞ্জনাও ৩ প্রকার। বাচ্যার্থের ব্যঞ্জনার উদাহরণ– কালো মধুঃ ইত্যাদি, লক্ষ্যার্থের উদাহরণ– নিঃশেষচ্যুতচন্দনম্ ইত্যাদি, ব্যঙ্গ্যার্থের উদাহরণ– পশ্য নিশ্চল ইত্যাদি।
Ø কুমারিল ভট্টের অনুসারী অভিহিতান্বয়বাদীগণ এই পূর্বোক্ত ৩ প্রকার (অভিধা, লক্ষণা ও ব্যঞ্জনা) বৃত্তি ছাড়াও তাৎপর্য নামক চতুর্থী বৃত্তির স্বীকার করেন। প্রভাকরভট্টানুযায়ী অন্বিতাভিধানবাদীগণ কেবল পূর্বোক্ত ৩ প্রকার বৃত্তিই স্বীকার করেন।
********
No comments:
Post a Comment