সাহিত্যদর্পণ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
সাহিত্যদর্পণ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ (Part - 1)
লক্ষণা
Ø মুখ্যার্থের অন্বয় বাধিত হলে রূঢি অর্থাৎ প্রসিদ্ধি অথবা প্রয়োজনবশতঃ শব্দের যে শক্তির দ্বারা মুখ্যার্থসম্বদ্ধ অন্য এক অর্থের প্রতীতি হয় শব্দের সেই শক্তিকে লক্ষণা বলে। বিশ্বনাথের ভাষায়–
মুখ্যার্থবাধে তদ্যুক্তো যযান্যোঽর্থঃ প্রতীয়তে।
রূঢেঃ প্রয়োজনাদ্বাসৌ লক্ষণা শক্তিরর্পিতা॥
Ø রূঢিমূলা প্রয়োজনমূলা ভেদে লক্ষণা ২ প্রকার। রূঢিমূলার উদাহরণ – কলিঙ্গঃ সাহসিকঃ, প্রয়োজনমূলার উদাহরণ– গঙ্গায়াং ঘোষঃ। (কলিঙ্গ দেশের নাম, অচেতন দেশ কখনও সাহসী হতে পারে না তাই এখানে কলিঙ্গ শব্দের মুখ্য অর্থ দেশের সাহসী অর্থের সঙ্গে অন্বয় বাধিত হয় তাই মুখ্যার্থসম্বদ্ধ কলিঙ্গদেশবাসী এই রকম ভিন্নার্থের প্রতীতি হয়। তার ফলে কলিঙ্গদেশবাসী সাহসী এইরূপ অর্থ পাওয়া যায়, এইরূপ ব্যবহার প্রসিদ্ধিবশতঃ হয় তাই এটি রূঢিমূলা লক্ষণা। তোমার গ্রাম কোথায় জিজ্ঞাসার উত্তর গঙ্গায়াং ঘোষঃ অর্থাৎ গঙ্গায় আমার গ্রাম। জলপ্রবাহরূপী গঙ্গাতে কখনও গ্রাম থাকতে পারে না তাই অন্বয় বাধিত হয় তাই গঙ্গা শব্দের অর্থ গঙ্গাতীর হয়। এখানে বক্তা গঙ্গাতীরে ঘোষঃ এইরূপ বলতে পারত কিন্তু গঙ্গায় যে পবিত্রতা, শীতলতা প্রভৃতি গুণ বিদ্যমান সেগুলি আমার গ্রামেও আছে এটি বোঝানোর জন্য গঙ্গায় আমার গ্রাম এইরূপ বলেছে। এখানে এই প্রয়োগ পবিত্রতাদি গুণ বোঝানোর উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে করা হয়েছে তাই এটি প্রয়োজনমূলা লক্ষণা)
Ø উপর্যুক্ত ২ প্রকার লক্ষণা উপাদানলক্ষণা, লক্ষণলক্ষণা ভেদে ২ প্রকার।
Ø বাক্যার্থে যে শক্তির দ্বারা মুখ্যার্থ নিজের অন্বয়সিদ্ধির জন্য মুখ্যার্থ ভিন্ন অর্থের আক্ষেপ করে তাকে উপাদানলক্ষণা বলে। বিশ্বনাথের ভাষায়–
মুখ্যার্থস্যেতরাক্ষেপো বাক্যার্থেঽন্বয়সিদ্ধয়ে।
স্যাদাত্মনোঽপ্যুপাদানাদেষোপাদানলক্ষণা॥
এই লক্ষণার অপরনাম অজহৎস্বার্থা লক্ষণা। উদাহরণ – রূঢিমূলা উপাদানলক্ষণা – শ্বেতো ধাবতি, প্রয়োজনমূলা উপাদানলক্ষণা – কুন্তাঃ প্রবিশন্তি।
(এই লক্ষণাতে আক্ষেপের দ্বারা প্রতীত অর্থের সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যার্থেরও গ্রহণ হয়, তাই একে উপাদানলক্ষণা বলে। শ্বেত দৌড়াচ্ছে বললে অচেতন শ্বেত অর্থাৎ শুক্লগুণের দৌড়ানো ক্রিয়ায় অন্বয় হয় না তাই শ্বেতশব্দের দ্বারা শ্বেতগুণবিশিষ্ট অশ্বের আক্ষেপ হয়। তার ফলে শ্বেত অশ্বটি দৌড়াচ্ছে এইরূপ অর্থ সিদ্ধ হয়। এখানে আক্ষেপের দ্বারা প্রতীত সারমেয় অর্থের সাথে সাথে শ্বেত অর্থটিরও গ্রহণ হয় তাই উপাদানলক্ষণা। তেমনই কুন্তাঃ প্রবিশন্তি এখানে অচেতন বল্লমের প্রবেশ অসম্ভব তাই বল্লমের দ্বারা বল্লমধারী পুরুষের আক্ষেপ হয়, তার ফলে বল্লমধারী পুরুষের প্রবেশ করছে এইরূপ অর্থ হয়। এখানে পুরুষের সাথে সাথে বল্লম অর্থটিরও গ্রহণ হয় তাই এটি উপাদানলক্ষণা)
Ø বাক্যার্থে যে শক্তির দ্বারা মুখ্যার্থভিন্ন অর্থের অর্থাৎ লক্ষ্যার্থের অন্বয়সিদ্ধির জন্য মুখ্যার্থের পরিত্যাগ হয় তাকে লক্ষণলক্ষণা বলে। বিশ্বনাথের ভাষায়–
অর্পণং স্বস্য বাক্যার্থে পরস্যান্বয়সিদ্ধয়ে।
উপলক্ষণহেতুত্বাদেষা লক্ষণলক্ষণা॥
এই লক্ষণার অপরনাম জহৎস্বার্থা লক্ষণা। উদাহরণ– রূঢিমূলা লক্ষণলক্ষণা– কলিঙ্গঃ সাহসিকঃ, প্রয়োজনমূলা লক্ষণলক্ষণা – গঙ্গায়াং ঘোষঃ। (এই লক্ষণায় মুখ্যার্থের গ্রহণ হয় না তাই একে লক্ষণলক্ষণা বলে। কলিঙ্গঃ সাহসিকঃ এখানে অচেতন কলিঙ্গদেশ সাহসী হতে পারে না তাই কলিঙ্গদেশরূপ মুখ্যার্থ পরিত্যাগ করে কলিঙ্গদেশনিবাসী এইরূপ অর্থ পাওয়া যায়। গঙ্গায়াং ঘোষঃ এখানে জলপ্রবাহরূপ গঙ্গায় গ্রাম থাকতে পারে না তাই গঙ্গাশব্দ জলপ্রবাহরূপ মুখ্যার্থ পরিত্যাগ করে গঙ্গাতীর এইরূপ অর্থ প্রতিপাদন করে। তার ফলে গঙ্গাতীরে গ্রাম এইরূপ অর্থ হয়। কুন্তাঃ প্রবিশন্তি ইত্যাদি উপাদানলক্ষণাতে কুন্তাধারীপুরুষের সাথে সাথে কুন্তারও প্রবেশ হয় কিন্তু গঙ্গায়াং ঘোষঃ ইত্যাদি লক্ষণলক্ষণাস্থলে ঘোষ তীরেই থাকে গঙ্গাতে নয়)
Ø উপর্যুক্ত ৪ প্রকার লক্ষণা সারোপা সাধ্যবসানা ভেদে প্রত্যেকে ২ প্রকার।
Ø যে লক্ষণায় অনাচ্ছাদিত অর্থাৎ পদের দ্বারা প্রতিপাদিত বিষয়ের=মুখ্যার্থের সঙ্গে বিষয়ীর=লক্ষ্যার্থের তাদাত্ম্য প্রতীত হয় তাকে সারোপা লক্ষণা বলে। আর আচ্ছাদিত অর্থাৎ পদের দ্বারা অপ্রতিপাদিত বিষয়ের=মুখ্যার্থের সঙ্গে বিষয়ীর=লক্ষ্যার্থের তাদাত্ম্য প্রতীত হয় তাকে সাধ্যবসানা। বিশ্বনাথের ভাষায়–
বিষয়স্যানিগীর্ণস্যান্যতাদাত্ম্যপ্রতীতিকৃৎ।
সারোপা স্যান্নিগীর্ণস্য মতা সাধ্যবসানিকা॥
সারোপা হল রূপকালঙ্কারের বীজ। সাধ্যবসানিকা হল অতিশয়োক্তি অলঙ্কারের বীজ। সারোপার উদাহরণ যথা – অশ্বঃ শ্বেতো ধাবতি। (এখানে অশ্বশব্দের দ্বারা প্রতিপাদিত মুখ্যার্থ অশ্বের সাথে লক্ষ্যার্থ শ্বেতগুণবিশিষ্টরূপ অর্থের তাদাত্ম্য প্রতীত হচ্ছে তাই এটি সারোপার উদাহরণ।) সাধ্যবসানিকার উদাহরণ হল– শ্বেতো ধাবতি। (এখানে কোনো পদের দ্বারা অপ্রতিপাদিত আক্ষেপের দ্বারা লব্ধ অশ্বের সাথে লক্ষ্যার্থ শ্বেতগুণবিশিষ্টরূপ অর্থের তাদাত্ম্য প্রতীত হচ্ছে তাই এটি সাধ্যবসানিকার উদাহরণ।)
Ø উপর্যুক্ত ৮ প্রকার লক্ষণা আবার প্রত্যেকে শুদ্ধা ও গৌণী ভেদে ২ প্রকার। যে লক্ষণার প্রয়োজক সাদৃশ্যভিন্ন সম্বন্ধ অর্থাৎ কার্যকারণভাব প্রভৃতি তাকে শুদ্ধা বলে, যে লক্ষণার প্রয়োজক সাদৃশ্যসম্বন্ধ তাকে গৌণী বলে। বিশ্বনাথের কথায়–
সাদৃশ্যেতরসম্বন্ধাঃ শুদ্ধাস্তাঃ সকলা অপি।
সাদৃশ্যাত্তু মতা গৌণ্যস্তেন ষোড়শভেদিতাঃ॥
তাহলে মোট ১৬ প্রকার লক্ষণা পাওয়া গেল–
Ø ক্রমশঃ উদাহরণগুলি হল–
o রূঢিমূলা উপাদানলক্ষণা সারোপা শুদ্ধা – অশ্বঃ শ্বেতো ধাবতি।
o রূঢিমূলা উপাদানলক্ষণা সাধ্যবসানা শুদ্ধা – অশ্বঃ ধাবতি।
o রূঢিমূলা লক্ষণলক্ষণা সারোপা শুদ্ধা – কলিঙ্গঃ পুরুষো যুধ্যতে।
o রূঢিমূলা লক্ষণলক্ষণা সাধ্যবসানা শুদ্ধা – কলিঙ্গঃ সাহসিকঃ।
o রূঢিমূলা উপাদানলক্ষণা সারোপা গৌণী – এতানি তৈলানি হেমন্তে সুখানি।
o রূঢিমূলা উপাদানলক্ষণা সাধ্যবসানা গৌণী – তৈলানি হেমন্তে সুখানি।
o রূঢিমূলা লক্ষণলক্ষণা সারোপা গৌণী – রাজা গৌডেন্দ্রং কণ্টকং শোধয়তি।
o রূঢিমূলা লক্ষণলক্ষণা সাধ্যবসানা গৌণী – রাজা কণ্টকং শোধয়তি।
o প্রয়োজনমূলা উপাদানলক্ষণা সারোপা শুদ্ধা – এতে কুন্তাঃ প্রবিশন্তি।
o প্রয়োজনমূলা উপাদানলক্ষণা সাধ্যবসানা শুদ্ধা – কুন্তাঃ প্রবিশন্তি।
o প্রয়োজনমূলা লক্ষণলক্ষণা সারোপা শুদ্ধা – আয়ুর্ঘৃতম্।
o প্রয়োজনমূলা লক্ষণলক্ষণা সাধ্যবসানা শুদ্ধা – আয়ুঃ পিবতি।
o প্রয়োজনমূলা উপাদানলক্ষণা সারোপা গৌণী – এতে রাজকুমারা গচ্ছন্তি।
o প্রয়োজনমূলা উপাদানলক্ষণা সাধ্যবসানা গৌণী – রাজকুমারা গচ্ছন্তি।
o প্রয়োজনমূলা লক্ষণলক্ষণা সারোপা গৌণী – গৌর্বাহীকঃ।
o প্রয়োজনমূলা লক্ষণলক্ষণা সাধ্যবসানা গৌণী – গৌর্জল্পতি।
Ø ৮ প্রকার প্রয়োজনমূলা প্রত্যেকে প্রয়োজনরূপ ব্যঙ্গের গূঢ়তা ও অগূঢ়তা ভেদে ২ প্রকার। তাহলে প্রয়োজনমূলা লক্ষণা ৮X২=১৬। সেই প্রয়োজনরূপ ব্যঙ্গ ধর্মগত ও ধর্মিগত ভেদে প্রত্যেকে ২ প্রকার। তার ফলে সর্বসমেত প্রয়োজনমূলা লক্ষণা ১৬X২=৩২। রূঢিমূলা ৮। মোট ৩২+৮=৪০। চল্লিশ প্রকার আবার পদ ও বাক্য ভেদে প্রত্যেকে ২ প্রকার। এইভাবে সর্বসমেত লক্ষণার প্রকারভেদ হল ৪০X২=৮০।
********
No comments:
Post a Comment